উন্নত জীবনের আশায় কিশোর বয়সেই মাথায় ঢুকেছিল ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন। বয়স বেশি দেখিয়ে জোগাড় করে ফেলেন পাসপোর্টও। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান মা–বাবা। এরপর অভিমানে আর পড়াশোনায় মন বসেনি। তবে দমে যায়নি স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছা। বাবার কাছ থেকে ১৭ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেন মাছ চাষ।
১৬ বছরের ব্যবধানে মো. আমিরুল ইসলামের (৩৩) এখন একটি থেকে আটটি পুকুর হয়েছে, হয়েছে পাকা বাড়ি, দিয়েছেন গরু–ছাগল ও হাঁস–মুরগির খামার। বছর শেষে আয় করছেন ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার মাঘান সিয়াধার ইউনিয়নের পেরীরচর গ্রামের আমিরুল এখন অন্যদের কাছেও আদর্শ। তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে এলাকার অনেকেই ঝুঁকছেন মাছ চাষে।
বাধা পেয়ে হলেন উদ্যোক্তা
আমিরুল ইসলামের এক দূর–সম্পর্কের মামা ইতালি থাকতেন। ২০০৩ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমিরুল দেখলেন, ইতালি থেকে তাঁর মামা মাসে মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠান। তাঁরও সাধ জাগে ইতালি যাওয়ার। ওই বছরই নিজের বয়স বেশি দেখিয়ে দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার জন্য একটি পাসপোর্ট করেন। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেননি মা–বাবা। রাগ আর অভিমানে লেখাপড়া ছেড়ে দেন তিনি। কী করবেন ভাবতে ভাবতেই কেটে যায় একটি বছর।
২০০৪ সালের শুরুতে কৃষক বাবা আলী উসমানের (৭০) কাছ থেকে ১৭ হাজার টাকা চেয়ে নেন আমিরুল। তখনকার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ নিয়ে বাড়ির সামনের পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া চার কাঠা (৪০ শতক) আয়তনের পরিত্যক্ত পুকুরে শুরু করেন মাছ চাষ। ১৭ হাজার টাকা খরচ করে বছর শেষে মাছ বিক্রি করে তিনি পান ৬০ হাজার টাকা। লাভের মুখ দেখে পরের বছর বাড়ির সামনে ৫২ কাঠা আয়তনের এক ফসলি নিচু জমিতে ছয় হাজার টাকার পোনা ছাড়েন। সব মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। আর মাছ বিক্রি করে পান আড়াই লাখ টাকা। এরপর শুধুই সাফল্যের দেখা পেয়েছেন আমিরুল।
একটি পুকুর থেকে আটটি
প্রথমে চার কাঠা পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন আমিরুল। এখন সেই পুকুরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটটিতে। এর মধ্যে দুটি পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেওয়া, বাকি ছয়টি নিজের। ওই আট পুকুরের পরিমাণ প্রায় ১১৫ কাঠা (১ কাঠা=১০ শতক)। প্রতিটি পুকুরপাড়েই রয়েছে শত শত কলাগাছ। ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে লেবু ও মাল্টাগাছ। এসব বিক্রি করেও আয় করেন তিনি। আটটি পুকুরের মধ্যে দুটিতে তেলাপিয়া মাছ চাষ, দুটি পুকুরে পোনা মজুত, দুটিতে রেণু থেকে পোনা উৎপাদন ও অপর দুটি পুকুরের একটিতে পাবদা, মাগুর, রুই, কাতলা, সরপুঁটি, গ্রাসকার্প এবং অন্য পুকুরটিতে চিতল, বোয়াল, আইড়, শোল, রুই, কাতলা, সরপুঁটি, গ্রাসকার্পসহ অন্যান্য মাছ চাষ করছেন। বছর শেষে খরচ বাদে এখন তাঁর আয় হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা।
উদ্যোক্তা হওয়ার আগে পুকুরপাড়ে একচালা একটি টিনের ঘরে থাকতেন আমিরুল। মাছ চাষের আয় দিয়ে দুইতলা ভিত দিয়ে নির্মাণ করেছেন তিনকক্ষের একটি পাকা ভবন। গড়ে তুলেছেন একটি খামার। সেখানে এক পাশে ৬টি গরু, ৫টি ছাগল, ২০টি রাজহাঁস, ৩০টি মুরগি রয়েছে। পুকুরগুলোর আশপাশে প্রায় ২৫ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন ২০ কাঠা জমি। সাফল্যের দেখা পেয়ে ২০১৩ সালে বিয়ে করেন আমিরুল। সংসারে এসেছে এক মেয়ে (৫) ও এক ছেলে (২)।
ছেলের মাছ চাষ নিয়ে বাবা আলী উসমান বললেন, ‘আমি খুউব কষ্ট কইরা সম্পদ কামাই করছি। আমার ছেড়া হালাল পথে টেহাই কামাইতাছে দেইখ্যা আমরা বেহের ভালা লাগতাছে। অনেহেই হের কাছে আইয়া পরামর্শ নেয় দেইখ্যা মনডা আনন্দে ভইরা যায়।’
আমিরুলের হাত ধরে কর্মসংস্থান
মাছের খাবারসহ অন্যান্য কাজ করার জন্য আমিরুল দুজন লোক রেখেছেন। খাবারসহ বছর শেষে তাঁদের বেতন দিতে হয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া মাছ ধরা, পোনা ছাড়ার কাজে দৈনিক ৫-৬ জন লোক কাজ করেন। তাঁদের দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা।
নিজের কাজে সফল হতে আমিরুল উপজেলা মৎস্য বিভাগ থেকে ২০১৪ সালে রেণু থেকে পোনা উৎপাদনবিষয়ক তিন দিনের এবং ২০১৭ সালে উপজেলা পর্যায়ে ধানখেতে মাছ চাষবিষয়ক তিন দিনের ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে গত বছরে গরু মোটাতাজাকরণ বিষয়ে তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ নেন। সর্বশেষ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকেও মাসব্যাপী মাছ চাষে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
আমিরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় কৃষিকাজের পাশাপাশি মাছ চাষে এগিয়ে এসেছেন এলাকার বিভিন্ন বয়সের ৮–১০ জন ব্যক্তি। মাছ চাষে অভিজ্ঞতা থাকার কারণে মাছের রোগবালাই রোধ ও মাছের উৎপাদন কীভাবে বৃদ্ধি হবে, এ নিয়ে স্থানীয় মৎস্যচাষিদের পরামর্শ তিনিই দিয়ে আসছেন।